ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়াঃ অবদান পরিচালকের
News Update: 26-Jul-2017
লিখেছেন ঃ ডাঃ লুতফুন্নাহার নিবিড়ছবি ঃ হিমেল বিশ্বাস, প্ল্যাটফর্ম মমেক প্রতিনিধি
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে রোজ সকালে একটা দৃশ্য আপনার চোখে পড়বেই, অনেক রোগী আউটডোর থেকে ঔষধের গুদামের দিকে যাচ্ছে; সেবা এবং ঔষধ দু’টি জিনিসের নিশ্চয়তাই মানুষ এখন পাচ্ছে এই হাসপাতালে। আউটডোরের দরজায় বড় করে সিটিজেন চার্টার টাঙানো। নাগরিক হিসেবে এই হাসপাতাল থেকে আপনি কি কি সুবিধা পাবেন, তা-ই লেখা রয়েছে এই চার্টারে। আর ইনডোর রোগীদের জন্য শতভাগ ঔষধ সরবরাহের অঙ্গীকারমূলক নোটিশ রয়েছে একটু পরে পরেই। গাইনি বিভাগের যে বারান্দা আঁশটে গন্ধ আর রক্তে ভরে থাকত, তাতে আজ ময়লার টুকরোও নেই; রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় রোগীদের জন্য রান্না করা খাবারের সুগন্ধে মাঝে মাঝে ডাক্তাররাও আফসোস করেন- কেন যে রোগী হলাম না!! ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য আছে ২৪ ঘন্টা সক্রিয় সিসি টিভি ক্যামেরা আর স্টাফদের প্রত্যেকের সঠিক ইউনিফরম। দালালের দৌরাত্ব পুরোপুরি নির্মূল না হলেও কমেছে অনেকখানি। আর এতসব পরিবর্তনের পিছনে যেই মানুষটি রয়েছেন, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাননীয় পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোঃ নাছির উদ্দীন আহমদ স্যার। তাঁর প্রায় একক প্রচেষ্টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোগীদের এবং একই সাথে ডাক্তারদের জন্য একটি চমৎকার স্থান হয়ে উঠেছে। মানুষ হচ্ছে হাসপাতালমুখী, আর ডাক্তাররাও সেবা দিয়ে পাচ্ছেন তৃপ্তি। ব্রিগেডিয়ার মোঃ নাছির উদ্দীন স্যার যখন এই হাসপাতালে আসেন, তখন সত্যিকার অর্থেই হাসপাতালের অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। বেশিরভাগ ঔষধ, গ্লাভস, ক্যাথেটার, অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস রোগীদের কিনে আনতে হত। দরিদ্র রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসা ছিল ওয়ার্ড ফান্ড। ডাক্তাররা নিজের গাঁট থেকে বা বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে গরীব রোগীদের সাহায্য করতেন। কিন্তু স্যার দায়িত্ব পাওয়ার পর পর ঘটনার মোড় বদলে গেল। স্যার সবচেয়ে হাসপাতালের দুর্নীতিগ্রস্থ অংশে হাত দিলেন- চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দৌরাত্ব কমানোর জন্য স্যার ক্রাশ প্লান নিলেন। কর্মচারী ইউনিয়ন ও বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজনৈতিক চাপও স্যারকে টলাতে পারল না। স্যার বললেন, “আমি কতটুকু দুর্নীতি বন্ধ করতে পারব জানি না, কিন্তু আমি এখানে থাকতে চোরদেরকে শান্তিতে চাকরি করতে দিব না”। এরমাঝেই কিছু বহিরাগত মাস্তান এসে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করে কয়েকজন চিকিৎসককে; উত্তাল হয়ে ওঠে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ডাক্তাররা বিচার দাবী করতে গেলে দেখা যায়, হাসপাতালের সিসি টিভি ক্যামেরা গুলো নষ্ট, যে কয়টা ঠিক আছে সেগুলোর রেকর্ডিং ফ্যাসিলিটি নষ্ট। স্যার অপরাধীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিলেন আর সিসি ক্যামেরা ঠিক করার জন্য চাইলেন এক মাস সময়। স্যারের কথার একটুও নড়চড় হয়নি, ২৭ লক্ষ টাকা হাসপাতালের ফান্ড থেকেই এলো। ঠিক হল সবগুলো ক্যামেরা আর পুরো ময়মনসিংহের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়ে অপরাধী গ্রেফতার হল ঠিক ২৪ ঘন্টার মাথায়। অপরাধী গ্রেফতার হবার পর ইন্টার্নদের স্যার ডেকে বললেন, “বাবা- মায়েরা আমি তোমাদের বাবা হই। তোমাদের এই সমস্যার দায়ভার আমার। তোমাদের কষ্টে আমি এই দুদিন ঘুমাতে পারিনি; আজ একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব”। স্যার হাসপাতালের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ফার্স্ট রেসপন্ডার তথা ইন্টার্ন ও নার্সদের সাথে মিটিং করে সমস্যা চিহ্নিত করেন। মিড লেভেল ও প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে মিটিং করেন; অনেক অনেক যন্ত্রপাতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। বিশেষ করে ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে হোল ব্লাডের পাশাপাশি, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, প্যাকড রেড সেল কিংবা প্লাটিলেট দেওয়ার উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো যুগান্তকারী। শুধুমাত্র এই জিনিসগুলোর জন্যই অনেক রোগীকে ঢাকাতে রেফার করতে হত। এখন হাসপাতালের খাবার উন্নত, হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন- আলোয় আলোকিত, ক্যানুলা থেকে শুরু করে অপারেশনের সুতো কিংবা মাইক্রোপোরটি পর্যন্ত সাপ্লাই পাওয়া যায়। মাঝে মাঝেই যে জিনিসপত্রগুলোর গুণগত মান কমে যায় না- এমন নয়। তবে মাননীয় পরিচালক স্যার এবিষয়ে এখনও কাজ করে চলেছেন। শত বাধা-বিঘ্ন আর অশান্তির মাঝে, প্রচন্ড কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠা ডাক্তাররা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে্ন- যখন তাঁরা দেখেন শকের রোগীকে বাঁচানোর জন্য ইমার্জেন্সি স্যালাইনটি কিনে আনার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। কিংবা অপারেশনের ঔষধ কেনার টাকা নেই বলে অনেক রোগীই মন খারাপ করে ফিরে যাচ্ছে না। তাঁদের এত কষ্ট এত শ্রম বৃথা যাচ্ছে না- তখন তাঁরা একটু হাসেন, এবং অবশ্যই মনে মনে পরিচালক স্যারকে ধন্যবাদ দেন।